ওমিক্রনের প্রভাবে দেশে বর্তমানে করোনা মহামারীর তৃতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। তবে এ সময়ে আক্রান্তদের মধ্যে মুমূর্ষু হওয়ার ও মৃত্যু হার কম। এর মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে টিকার আওতায় আনার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। সরকারি সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ অন্তত টিকার একটি ডোজ হলেও পেয়েছেন। ৫০ শতাংশ মানুষ গ্রহণ করেছেন টিকার দুটি ডোজই। এ ছাড়া প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। এখনো যারা বাকি রয়েছেন, তাদের টিকার আওতায় আনতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে এ পর্যন্ত করোনার টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৯ কোটি ৭০ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৮ জন। দুই ডোজ টিকাই পেয়েছেন ৬ কোটি এক লাখ ৫ হাজার ৬২৫ জন। এ ছাড়া বুস্টার পেয়েছেন ১৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৮ জন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছে এক কোটি ৩৯ লাখ ৭ হাজার ৪৮৬ জন। দুই ডোজ টিকা পেয়েছে ২০ লাখ ১৫ হাজার ২৩৮ জন। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ বুস্টার ডোজ পাননি। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দেশে বুস্টার ডোজ গ্রহণের বয়সসীমা কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে ১২ বছরের ওপরে যে কেউ এখন থেকে টিকা নিতে পারবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। দেশে এতদিন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের নাগরিকরা বুস্টার ডোজ গ্রহণ করতে পারছিলেন।
গতকাল রাজধানীর মহাখালীর বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্সে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে জাহিদ মালেক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব মানুষকে টিকা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যেই ৯ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ এবং সাড়ে ৬ কোটি মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। বস্তিতে গিয়েও টিকা দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের স্কুলে স্কুলে গিয়ে আমরা টিকা দিচ্ছি। এর পরও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রায় আড়াই কোটির মতো মানুষ টিকা গ্রহণে বাকি রয়েছে। বিশেষ করে যারা ভ্রাম্যমাণভাবে চলাফেরা করে, দোকানপাট, কল-কারখানায়, লঞ্চ-স্টিমারে কাজ করেন, তারা টিকার আওতায় আসছেন না। এ কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে ভ্রাম্যমাণ মানুষদের জনসনের টিকা দেওয়া হবে। জনসনের টিকা মাত্র এক ডোজ দিলেই চলে। সরকার এ পর্যন্ত সাড়ে ১৭ কোটি ডোজ টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে। এ মুহূর্তে সরকারের হাতে আরও প্রায় ৯ কোটি ডোজ টিকা রয়েছে। এ কারণে ১২ বছরের ঊর্ধ্বে সবাইকে দিলেও টিকা শেষ হবে না।
ওমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তিকে এখন থেকে ১৪ দিনের পরিবর্তে ১০ দিন আইসোলেশনে রাখতে হবে বলেও উল্লেখ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বিশ^ব্যাপী আক্রান্তের হার লাখ লাখ। পাশর্^বর্তী দেশেই সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। অথচ আমরা মাস্ক না পরে, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যত্রতত্র চলাফেরা করছি। স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে, অথচ শিশুদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া হচ্ছে। এটা ঠিক না। জনগণকে স্বাস্থ্য সচেতনতায় এগিয়ে আসতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব লোকমান হোসেন মিয়া ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউএইচও) বলে আসছে, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে হলে একটি দেশের মোট জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৭০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনতে হবে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী, বাংলাদেশের লক্ষ্য দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া। সাড়ে ১২ কোটি জনগণ হিসাবে সেটাই মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে কোটিখানেক লোক দেশের বাইরে আছে। তারা কিছু টিকা আমাদের এখান থেকে নিয়ে যায় আবার কিছু টিকা বিদেশে নিয়ে থাকে। তবে এই হিসাবে টিকা পরিকল্পনার বাইরে থাকবে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। সেই হিসাবে এই জনসংখ্যা ৭০ শতাংশ হলো প্রায় ১২ কোটির মতো। সরকার এই ১২ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার কথা বলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়া হলেও হার্ড ইমিউনিটির হিসাবটি নির্ভর করে ওই ভাইরাসটির সংক্রমণের সক্ষমতার ওপর। যেমন হামের হার্ড ইমিউনিটির জন্য ৯৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে এবং পোলিওর ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনলেই হয়।
এদিকে এরই মধ্যে প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থী টিকা পাওয়ায় দেশে আবারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার ব্যাপারে জোরাল মত ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে দেশের স্কুল কলেজ খুলে দেওয়া যেতে পারে। কারণ অনেক শিক্ষার্থী টিকা পেয়েছে। তা ছাড়া সারা পৃথিবীতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই খোলা রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের মনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এমনকি তাদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতাও দেখা দিতে পারে।
শিশুদের স্কুলমুখী করার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ ১২ বছরে ঊর্ধ্ব এক কোটির বেশি শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে অন্তত একটি ডোজ টিকা পেয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডায় স্কুল, কলেজ খোলা রয়েছে। ওইসব দেশের সংক্রমণের হার আমাদের তুলনায় অনেক বেশি হলেও তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক কার্যক্রম বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক-সুস্থ জীবন নিশ্চিতে এবং মানসিকভাবে সতেজ রাখতে আমাদেরও স্কুল কলেজ খোলা রাখা প্রয়োজন। আশা করছি, দুই সপ্তাহের জন্য স্কুলের কার্যক্রম স্থগিত থাকার পর এটি আর বাড়ানো হবে না।
দেশে টিকা উৎপাদনের অগ্রগতি কতদূর
কোভিড মহামারীর প্রাদুর্ভাবের পর পরই দেশে টিকা উৎপাদনের উদ্যোগ নেয় গেøাব বায়োটেক। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গত ২৪ নভেম্বর তারা বঙ্গভ্যাক্স নামে ওই টিকা মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমোদন পেয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৬০ জনের ওপর এই টিকা পরীক্ষা করা হবে। তার ফলের ওপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পরে এটি ব্যবহারের অনুমোদন মিলবে। অর্থাৎ সেই পরিস্থিতি হতে এখনোও কমপক্ষে ৬ মাস অপেক্ষা করতে হবে।
অন্যদিকে সরকারি উদ্যোগে দেশে টিকা উৎপাদন প্ল্যান্ট তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেখানে বিদেশ থেকে বাল্ক টিকা এনে বোতলজাত করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সেই প্ল্যান্ট স্থাপনে এখন গোপালগঞ্জে জমি অধিগ্রহণ চলছে। অর্থাৎ এই প্ল্যান্টের কার্যক্রম শুরু হতে কমপক্ষে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।