জাতীয়

স্বামী হত্যার বিচারের চেয়ে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাই বড়

(Last Updated On: )

কক্সবাজারের উখিয়ায় মুহিবুল্লাহ হত্যাকা-ের ১০ দিন পার হলেও আতঙ্ক কাটেনি রোহিঙ্গাদের। শরণার্থী শিবিরগুলোর অবস্থা থমথমে। পুলিশি পাহারায় রয়েছে মুহিবুল্লাহর পরিবার। এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল আসামিরা। মুহিবুল্লাহ হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে মহিবুল্লাহ গঠন করেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ (এআরএসপিএইচআর)। এ সংগঠনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গাদের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন মুহিবুল্লাহ। ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে মহাসমাবেশ করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়েন তিনি। রোহিঙ্গাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাও ছিল মিয়ানমারের এই স্কুলশিক্ষকের। মুহিবুল্লাহর পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, এই জনপ্রিয়তার কারণেই প্রত্যাবাসনবিরোধী সন্ত্রাসীরা

তাকে নিশানা বানায়। তাদের মতে, মুহিবুল্লাহর মৃত্যুতে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার স্বপ্ন অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিধবা নারী গুলবাহার বলেন, ‘মুহিবুল্লাহ আমাকে নিজের মায়ের মতো সম্মান করতেন, তার মৃত্যুতে আমরা অনিরাপদ হয়ে গেলাম। দিনে যেমন তেমন, রাতে এখন খুব ভয় লাগে।’ ফরিদা নামের এক নারী বলেন, ‘যিনি আমাদের সম্প্রদায়কে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করতেন, তাকেই আমাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা হত্যা করেছে। এর চেয়ে দুঃসংবাদ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য আর কী হতে পারে! আমরা রাতে খুব নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকি।’

কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা আবদুস সালাম বলেন, ‘অনেক স্বপ্ন ছিল দেশে ফিরে যাব, নিজের সম্পদ ফিরে পাব। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছে। আমরা মুহিবুল্লাহ হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

মুহিবুল্লাহর ভাতিজা রহিমুল্লাহ বলেন, ‘হত্যাকারীরা ওত পেতে আছে আরও বড় ঘটনা ঘটাতে। বাংলাদেশ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় তারা হয়তো সেটি করতে পারছে না।’

মুহিবুল্লাহর স্ত্রী নাসিমা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য জীবন দিয়েছেন। আমি একজন শহীদের স্ত্রী; এটাই এখন আমার বড় পরিচয়। আমার কাছে আমার স্বামী হত্যার বিচারের চেয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা অনেক বড়। আমি চাই রোহিঙ্গারা নিরাপদে থাকুক। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। এর পর আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।’

মুহিবুল্লার ভাই ও মামলার বাদী হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘মামলার পর থেকে আমরা অনিরাপদ হয়ে গেছি। আমাদের পুরো পরিবারকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটা আর কত দিন! আমাদের পরিবারের সদস্যদের এখন ক্যাম্পে বা এদেশে থাকাটাই অনিরাপদ হয়ে গেল।’

এআরএসপিএইচআর কার্যালয়ের অদূরেই মুহিবুল্লাহর কবর। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অনেক রোহিঙ্গা তার কবর জিয়ারত করছেন। রফিকুল ইসলাম, আলাউদ্দিন, আমির হোসেন, মোহাম্মদ নূর, আবুল কাশেম রহিমুল্লাহ নামের কয়েকজন জানান, তারা মুহিবুল্লাহর পথ অনুসরণ করেই পথ চলবেন।

এআরএসপিএইচআরের সাধারণ সম্পাদক মাস্টার জুবায়ের বলেন, ‘আমরা এখনো নিজ দেশে ফেরার জন্য প্রস্তুত আছি এবং আমরা সেই দাবিদাওয়া নিয়ে এগিয়ে যাব। মাস্টার মুহিবুল্লাহর দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। সাধারণ রোহিঙ্গারা তা ঠিক করবেন।’

কুতুপালংয়ের স্থানীয় ইউপি সদস্য ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘মুহিবুল্লাহ হত্যার পর ক্যাম্পে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। আমরা স্থানীয় জনগণও আতঙ্কের মধ্যে আছি। আশা করছি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাঈমুল হক জানান, মুহিবুল্লাহ হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা আর্সা সংগঠনের নামে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ছিল।

১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাঈমুল হক বলেন, ‘ক্যাম্পগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে এবং সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান পিপিএম বলেন, ‘মুহিবুল্লাহ হত্যাকা-ের সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, কীভাবে হত্যাকা- হয়েছে, সেসব বিষয়ে আমরা অনেকটা পরিষ্কার ধারণা পেয়েছি। সেগুলো নিয়ে জেলা পুলিশ, আর্মড পুলিশ, পিবিআই ও সিআইডি কাজ করছে।’

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ইলিয়াস নামের এক আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে একদল সন্ত্রাসী