এবার গ্রাহকদের কয়েক শ’ কোটি টাকা নিয়ে ‘লাপাত্তা’ হলো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিং। চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ও আকর্ষণীয় ছাড়ে পণ্য বিক্রির ফাঁদ তৈরি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ৫৮৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) জসিমউদ্দিন চিশতি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদের বেশির ভাগ সদস্য পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন বলে জানিয়েছে অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি)। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির অফিস বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের ফোন নম্বরও। এ অবস্থায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ধামাকায় অর্ডার পেমেন্ট করা হাজারো গ্রাহক। তবে শপিং প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও মাঝে মধ্যেই ফেসবুক লাইভে এসে গ্রাহকদের বিভিন্নভাবে আশ্বস্ত করে আসছেন কোম্পানির এমডি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি নিবন্ধন ছাড়াই ধামাকা শপিং কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেছে।
ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের লেনদেন হতো। গত জুন মাস পর্যন্ত এ অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়। তখন পর্যন্ত এ অ্যাকাউন্টে লেনদেনের পরিমাণ ৫৮৮ কোটি ৯১ লাখ ৫ হাজার ৮৫২ টাকা। তবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন হলেও বর্তমানে অ্যাকাউন্টটিতে রয়েছে মাত্র ৯৩ হাজার ৭৩১ টাকা।
গত ১৫ আগস্ট হঠাৎ করেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি তাদের ফেসবুক পেইজে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে গ্রাহকদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়, আপনারা ইতিমধ্যে জেনেছেন আমাদের আর্থিক লেনদেন নিয়ে তদন্ত চলছে এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাছে আমরা প্রতিনিয়ত জবাবদিহিতার মধ্যে আছি। আমাদের সম্মানিত এমডি স্যার ম্যাসেনজিং গ্রুপের মাধ্যমে সর্বদা যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন এবং রাখবেন। দয়া করে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের কার্যক্রমের ব্যাপারে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। তবে এর আগ থেকেই ডেলিভারি কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
এরপর ১৬ই আগস্ট ফেসবুক পেইজের মাধ্যমেই সেলারদের উদ্দেশ্যে আরেকটি নোটিশ দেয় ধামাকা শপিং। এতে বলা হয়, ধামাকার সকল সেলারদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আমাদের ধামাকা শপিং প্রতিষ্ঠানসহ বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বর্তমানে এনবিআর ও সিআইডি’র তদন্তে রয়েছে। তাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে আমাদের কাছে যে তথ্য এবং হিসাব বিবরণী রয়েছে তার সঙ্গে সেলারদের হিসাব বিবরণী মিলিয়ে দেখার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সেজন্য সেলারদের কাছে হিসাব বিবরণী দ্রুত দেয়ার জন্য আহ্বান করে ধামাকা।
এরপর ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠানের এমডি জসিমউদ্দিন চিশতি ফেসবুক লাইভে এসে গ্রাহকদের আশ্বস্ত করেন। একইসঙ্গে দ্রুত ডেলিভারি এবং রিফান্ড দেয়ার আশ্বাসও দেন তিনি। এরপর ২০ আগস্ট ফেসবুকে আরেকটি নোটিশ দেয় ধামাকা। সেখানে বলা হয়, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কাছে আমাদের অর্থনৈতিক এবং লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়াদি তদন্তাধীন। আমরা আশা করছি, খুব শিগগিরই সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সমাধান হবে। একইসঙ্গে ২৬ আগস্ট থেকে গ্রাহকদের ডেলিভারির আশ্বাস দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে আবারো ফেসবুক লাইভে এসে গ্রাহকদের কাছে সময় চান প্রতিষ্ঠানের এমডি।
পরবর্তী আরেকটি পৃথক নোটিশে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের পণ্য সরবরাহ ও দেনা-পাওনা বিষয়ক তথ্য জানতে চিঠি দিয়েছেন। চলমান বিষয়াদি নিষ্পত্তি না হওয়ার ফলে ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো ফ্রিজ অবস্থায় আছে এবং এর ফলে আমরা আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারছি না। তাই আপাতত পেমেন্ট প্রদান ও পণ্য ডেলিভারি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট প্রতিষ্ঠানের এমডি ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় গ্রাহকদের আশ্বস্ত করেন এবং আরও সময় চান। এরই প্রেক্ষাপটে গত বুধবার ধামাকা শপিংয়ের ফেসবুক পেজে বিজ্ঞপ্তিতে অনিবার্য কারণে কাস্টমার কেয়ারের ফোন নম্বরটি বন্ধ করা হয়েছে বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি। এতে ফেসবুক কমেন্টে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন গ্রাহকরা। এমন অবস্থার মধ্যেও প্রতিষ্ঠানটি আবারো আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে মাসব্যাপী নতুন ক্যাম্পেইনের ঘোষণা দেয়ায় গ্রাহকদের মধ্যে তীব্র চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
মহিউদ্দিন নামে একজন গ্রাহক বলেন, আমরা যারা বিগত ২-৩ মাস আগে অর্ডার পেমেন্ট করেছি সেগুলো আগে ডেলিভারি দিন। তারপরে নতুন করে অর্ডার করার চিন্তা-ভাবনা করা যাবে। মইন হাওলাদার নামে একজন বলেন, সনি র্যাংগসের প্রোডাক্ট অর্ডার করেছি। ৭ কার্যদিবসে ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু ৫৭ দিন হয়ে গেলেও প্রোডাক্ট পেলাম না। তাদের মতোই হাজার হাজার গ্রাহক অর্ডার পেমেন্ট করে পণ্যের ডেলিভারি কিংবা রিফান্ডের জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে ধামাকা শপিংয়ের একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটি আরও ৪ মাস আগেই তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের এমডিসহ পরিচালনা পর্ষদের অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি)’র বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ূন কবির বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা অনুসন্ধান করছি। আপাতত বলার মতো তেমন কিছু নেই। তবে কোম্পানির এমডিসহ অনেকেই বিদেশে চলে গেছেন। যে অ্যাকাউন্টে লেনদেন পরিচালনা করা হতো তাতে অল্প পরিমাণ টাকা রয়েছে। পাশাপাশি কোম্পানির সংশ্লিষ্ট অন্য যেসব অ্যাকাউন্ট রয়েছে তাতেও তেমন টাকা নেই।