আন্তর্জাতিক

১শ’ বছর ধরে মানচিত্রে অস্তিত্ববিহীন এক পর্বতমালা, রহস্যটা কোথায়


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

কং পর্বতমালার বিবরণে বলা আছে এই পর্বতমালার শৃঙ্গ আকাশছোঁয়া, কেউ কেউ বলেছেন এই পাহাড়ের চূড়া বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে। এই সুবিশাল পর্বতমালাকে উনবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় সব মানচিত্রে বেশ স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে।

অথচ এই পর্বতমালা যুগ যুগ ধরে ইউরোপীয় পর্যটকদের জন্য শুধুই কল্পনার খোরাক জুগিয়েছে, এর আদতে কোনো অস্তিত্বই কখনো ছিলো না। তাহলে মানচিত্র যা একটা বৈজ্ঞানিক দলিল, তাতে এই পর্বতমালা স্থান পেলো কীভাবে?

মানচিত্র তৈরিতে ‘ভূতুড়ে’ ঘটনা?

মানচিত্র তৈরির ইতিহাসে এই পর্বতমালা একটা ‘ভূতুড়ে’ ঘটনার কিংবদন্তি হয়ে আছে, বলছেন সাংবাদিক এবং অন দ্য ম্যাপ বইয়ের লেখক সাইমন গারফিন্ড। মানুষ কীভাবে বিশ্বকে দেখে এবং মানচিত্র কীভাবে পৃথিবীকে দেখায় তার মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে তিনি এই বই লিখেছেন।

স্কটল্যান্ডের একজন অভিযাত্রী মাঙ্গো পার্ক পশ্চিমের মানুষের কাছে প্রথম কং পর্বতমালার বর্ণনা দেন। তিনি আফ্রিকায় গিয়েছিলেন নিজার নদীর উৎস সন্ধানে এবং ১৭৯৫ থেকে ১৭৯৭ পর্যন্ত তার ওই অভিযানে তিনি আজকের সেনেগাল আর মালিতে গিয়ে পৌঁছেছিলেন।

তার ভ্রমণ কাহিনি লন্ডনে প্রকাশিত হয় ১৭৯৯ সালে। ওই বইয়ের সাথে ছিল একটি মানচিত্র যেটি এঁকেছিলেন ইংরেজ মানচিত্র বিশারদ (কার্টোগ্রাফার) জেমস রেনেল। ওই মানচিত্রে তিনি দেখান বিষুব রেখার দশ ডিগ্রি উত্তরে পশ্চিম আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অংশ বরাবর ছড়িয়ে আছে কং পর্বতমালা। কিন্তু কীভাবে যে তৈরি হয়েছিলো সেই মানচিত্র তা একটা ভৌতিক রহস্য।

এই পর্বতমালার নাম দেয়া হয়েছিলো কং শহরের নামে। কং রাজত্বের রাজধানী ছিলো ওই কং শহর। তাদের রাজত্বের প্রাণকেন্দ্র ছিলো বর্তমানের আইভরিকোস্ট এবং তার চারপাশ ঘিরে বার্কিনা ফাসোর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে।

মরীচিকা নাকি আবিস্কার?

এটা প্রমাণ করা খুবই কঠিন যে, পার্ক কি ওই পর্বতমালা আদৌ নিজের চোখে দেখেছিলেন, নাকি এই পর্বতমালার অস্তিত্ব তিনি আবিস্কার করেছিলেন?

‘হয়দতো তিনি পাহাড়ের মরীচিকা দেখেছিলেন, অথবা একগুচ্ছ মেঘ দেখে তার দৃষ্টিভ্রম হয়েছিলো যেটাকে তিনি পর্বতমালা বলে মনে করেছিলেন,’ বলছেন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক এবং পশ্চিম আফ্রিকার ভৌগলিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ টমাস ব্যাসেট।

‘এরপর তিনি হয়তো অন্য পর্যটক ও বণিকদের জিজ্ঞেস করেছিলেন ওই জায়গায় কোনো পর্বতমালা আছে কিনা এবং তারা হয়তো উত্তরে বলেছিলেন হ্যাঁ।’

তবে অধ্যাপক ব্যাসেট বলেছেন রহস্যের ইতি এখানেই নয়।

পশ্চিম আফ্রিকার সেই সময়কার ভৌগলিক মানচিত্র নিয়ে অন্যতম সবচেয়ে বড় এই রহস্য বুঝতে হলে ‘নিজার নদীর গতিপথ নিয়ে যে তত্ত্বগত বিতর্ক রয়েছে, এই কং পর্বতমালার অস্তিত্বকে সেই বিতর্কর পটভূমিতে বিচার করতে হবে’।

এই মানচিত্র বিশেষজ্ঞ ব্যাসেট বলছেন, কং পর্বতমালা যে আছে, সেটার মূল কারণ জেমস রেনেলের তৈরি মানচিত্র। এই পাহাড় নিয়ে পরস্পরবিরোধী অনেক তত্ত্ব রয়েছে। কিন্তু রেনেল কং পর্বতমালাকে মানচিত্রে তুলে ধরেছেন তার নিজস্ব ব্যাখ্যার নিরিখে।

‘পশ্চিম আফ্রিকায় স্বর্ণ ভাণ্ডার

সে সময়কার অন্যতম সবচেয়ে আস্থাভাজন ও সুপরিচিত ভূগোল বিশারদ রেনেল যুক্তি দিয়েছিলেন যে, নিজার নদী আতলান্তিক মহাসাগর থেকে পূব মুখ দিয়ে আফ্রিকা মহাদেশে প্রবাহিত হয়েছে, এরপর ওই নদী স্থলভাগের কোনো বদ্বীপের ভেতর হারিয়ে গেছে।

এখন কং পর্বতমালার অস্তিত্ব যদি সত্য হয়, তাহলে তার তত্ত্বও সত্যি বলে প্রমাণ করা সহজ হবে: অর্থাৎ বলা যাবে, এই বিশালায়াতন পাহাড়ে বাধা পাবার কারণেই নদীটি দক্ষিণ মুখে প্রবাহিত হয়ে বেনিন উপসাগরে পড়তে পারবে না।

রেনেল যে মানচিত্র এঁকেছিলেন, তা ওই এলাকায় ব্যাপক প্রভাব রেখেছিলো। উনবিংশ শতাব্দীতে আফ্রিকার যতো মানচিত্র আঁকা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতে কং পর্বতমালার অবস্থান দেখানো হয়েছে। তবে তার আকারে ও বিস্তৃতিতে বিভিন্ন মানচিত্র নির্মাতার কল্পনার প্রতিফলন দেখা গেছে।

কোনো কোনো মানচিত্রে দেখা গেছে এই পর্বতমালা আফ্রিকা মহাদেশের পুরো পশ্চিম থেকে পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত- সাহারা মরুভূমি এবং আফ্রিকার মধ্যাঞ্চলের মধ্যে একটি দেয়ালের মতো।

মানচিত্রে এই পর্বতমালার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে নীল রং দিয়ে এর ‘খুবই উচ্চ অংশগুলো’ চিহ্ণিত করা হয়েছে, এবং এর ঢাল দেখানো হয়েছে অনেকটা বন্ধ্যা অঞ্চল হিসাবে- কিন্তু পর্বতের এই বন্ধ্যা অংশকে স্বর্ণ-সমৃদ্ধ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

অনেক ইউরোপীয়ান মনে করতেন এই পর্বতমালা ‘পশ্চিম আফ্রিকার স্বর্ণ ভাণ্ডার’, বলা হতো বর্তমানের ঘানা দেশের আশান্তি সম্রাটদের বিপুল অর্থ সম্পদের উৎস ছিলো এই পাহাড়ে সঞ্চিত সোনার খনিগুলো। কিন্ত বাস্তব সত্য হলো নিজার নদী গাল্ফ অফ বেনিন উপসাগরে গিয়ে আসলেই পড়েছে।

এরপর ১৮৮৯ সালে, ফরাসি একজন অভিযাত্রী লুই গুস্তাফ বিংগার নিজার নদী বরাবর তার নিজস্ব অভিযাত্রা নিয়ে যে খবর দেন তা চমকে দেয় মানুষকে। প্যারিসের জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিকে তিনি জানান যে কং পর্বতমালা আদতেই নেই। কখনো এমন কোনো পাহাড়ই সেখানে ছিলো না।

আর যাদুর মতো এই বিশাল পর্বতমালা হঠাৎ করেই যেভাবে মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছিলো, সেভাবেই হঠাৎ করে তা কর্পূরের মত উবে যায়।

‘মানচিত্র সমাজের ছবি’

তবে অধ্যাপক ব্যাসেট বলছেন, এই পর্বতমালার অস্তিত্ব নিয়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ যাই থাকুক না কেন, যে পাহাড় ছিলোই না, সেই পাহাড়কে মানচিত্রে ঢোকানোর ঘটনা অন্তত এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, মানুষ তার নিজের পক্ষপাত তুলে ধরতে বা তার দৃষ্টি দিয়ে অন্যদের কোনো কিছু দেখাতে এমনকি মানচিত্রকেও ব্যবহার করেছে, যে মানচিত্রকে আমরা সবসময় ধ্রুব সত্য এবং বস্তুনিষ্ঠ বলে সবসময় জেনে এসেছি।

তিনি এক নিবন্ধে লিখেছেন, ভৌগলিক মানচিত্র সাধারণভাবে সমাজের বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে সংগৃহীত ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে একটা দেশ বা শহরের সামাজিক ছবি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে মানচিত্রে ‘ভৌগলিক দিক দিয়ে আগ্রহের দারুণ দারুণ অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হতো,’ বলছেন অধ্যাপক ব্যাসেট।

যেমন ষোড়শ শতাব্দীতে মানচিত্র নির্মাতা অর্টেলিয়াস নীল নদের উৎস হিসাবে মানচিত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার দু’টি বিশাল হ্রদের ছবি অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু কং পর্বতমালার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক বিষয়টা হলো শুধুমাত্র উনবিংশ শতাব্দীর মানচিত্রে এই পর্বতমালার অস্তিত্ব দেখানো হয়েছে বলে জানাচ্ছেন অধ্যাপক ব্যাসেট।

তার মতে ইউরোপীয় মানচিত্র প্রকাশকরা রেনেলের খ্যাতি ও সম্মানের মর্যাদা রক্ষায় এই ভুয়া তথ্যটি কখনো চ্যালেঞ্জ করেননি। তবে বিংগার যিনি এই পর্বতমালার অস্তিত্ব সরকারিভাবে নাকচ করে দেন, বলা হয় তার পেছনেও রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করেছে। কারণ তিনি এই তথ্য ফাঁস করেন যে সময়ে ফ্রান্স পশ্চিম আফ্রিকায় তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে তৎপর ছিলো।

ঔপনিবেশিক ক্ষমতার বিস্তার

উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় সরকারগুলোর জন্য মানচিত্রের আলাদা গুরুত্ব ছিলো। মানচিত্র শুধু ভৌগলিক অবস্থানের দলিল ছিলো না, মানচিত্র ছিলো ঔপনিবেশিক শাসকদের আধিপত্যেরও দলিল।

উনবিংশ শতাব্দীতে ভৌগলিক অবস্থানের পাশাপাশি এলাকার রাজনৈতিক মানচিত্রও গুরুত্ব পেতো। যে কারণে ব্রিটিশ, ফরাসি ও পর্তুগিজদের তৈরি একই এলাকার মানচিত্রে তারতম্য থাকত।

‘এই মানচিত্রগুলো ছিলো বিশ্ব পরিস্থিতির রাজনৈতিক প্রতিফলন’।

অধ্যাপক ব্যাসেট বলছেন, পশ্চিম আফ্রিকার এই কং পর্বতমালার কাহিনি থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, ‘মানচিত্রকেও সমালোচকের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে’। খবর: বিবিসি বাংলা।