‘অন্য শিশুদের মতো আমার সন্তানরাও কোলে উঠতে চায়। কিন্তু আমি এমনি মা, আমার সন্তানকে আদর করে একটু কোলেও নিতে পারি না। স্বামী-সন্তানের প্রয়োজনেও দ্রুত কোনো কাজে আসতে পারি না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার পঙ্গু রেবেকা খাতুন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজাধসে দু’পা হারান তিনি। আজ ২৪ এপ্রিল, রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডির আট বছর। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় দু’পা হারানো রেবেকা নানা ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে আজো সেই ভয়াল-দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন।
ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাই চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামের মোস্তাফিজার রহমানের স্ত্রী রেবেকা খাতুনের সঙ্গে গতকাল শুক্রবার কথা হয় আমাদের সময়-এর এই প্রতিনিধির। রেবেকা বলেন, রানা প্লাজার কথা হয়তো সবাই ভুলে যেতে বসেছে। কিন্তু আমি ভুলতে পারিনি আজো। আর পারবও না কখনো। কারণ এ দুর্ঘটনা আমার শরীরের অপরিহার্য অংশ- দুটি পা কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে আমার মা, ফুফু ও দাদির জীবন।
রেবেকা খাতুন আরও বলেন, ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল দেখে বিকাল ৪টায় ছুটি দিয়ে দেন কর্তৃপক্ষ। পরের দিন সকাল ৮টায় যথারিতি কাজে এসে বিল্ডিংয়ের ফাটলের কারণে কাজে যোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে রানা প্লাজার পক্ষ থেকে বলা হয় বেতন-ভাতাসহ অভারটাইমের টাকা দেওয়া হবে না এবং কারও চাকরি থাকবে না। টাকা এবং চকরি হারানোর ভয়ে সব শ্রমিকের সঙ্গে রেবেকাও কাজে যোগ দেন। সকাল ৯টায় তার মা নাস্তা খাওয়ার কথা বললে বলেন, একটু পরেই খাব। কিন্তু রেবেকার আর খাওয়া হয়নি তিন দিন। দুর্ঘটনায় অচেতন হয়ে ৩ দিন আটকা পড়ে ছিলেন ওই ভবনে। পরে উদ্ধার কর্মীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করান। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালে। আরও পরে জানতে পারেন তার শরীরের অপরিহার্র্য অংশ দুটি পা নেই। এরই মধ্যে তার দু’পায়ে ৮ বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। দীর্ঘ এক বছর ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফেরেন। এরই মধ্যে তার পঙ্গুত্ব জীবনজুড়ে আসে প্রথম সন্তান ছিদরাতুন মুনতাহা (৬) এবং মাদানী আন নুর (২)।
রেবেকা খাতুন বলেন, সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে যা পেয়েছি তা ভেঙেই সংসার চলছে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে বেসরকারি কিছু সংস্থাও তাদের কিছু সহায়তা দেয়। একটি বেসরকারি সংস্থা তার দুটি কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু ওই পা দিয়ে সমান জায়গা ছাড়া চলাচল সম্ভব নয়। কিংবা কোথাও গেলে পা লাগিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন। স্বামী ছাড়া তেমন চলাফেরা বা কোনো কাজ করতে পারেন না। এ বছর একটি বেসরকারি সংস্থা রেবেকার মাটির ঝুপড়ি বাড়ি থেকে বের করে পাশের অন্য জায়গায় একটি বাড়ি করে দিল। তারাই বর্তমানে মাঝে মধ্যে খোঁজখবর রাখেন রেবেকার। আক্ষেপ করে রেবেকা খাতুন র্আর বলেন, একজন কর্মক্ষম মানুষ এভাবে চলতে পারে না। পা হারিয়ে আজ কর্মহীন হয়ে সারাদিন বাড়িতে বসে কাটাতে হয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধস বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনার একটি। এতে ১ হাজার ১৩৮ জন পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে; আহত হন আরও দুই সহস্রাধিক শ্রমিক। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় পুরো বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। মানবসৃষ্ট ভয়াবহ সেই বিপর্যয়ের রেশ রয়ে গেছে এখনো।