- গাড়িচালকদের দুঃসময়ে গেলো তিনটি ঈদ
- গরিবের যন্ত্রণা-মধ্যবিত্ত পরিবারের হাহাকার
- চাকরিপ্রত্যাশীদের অনেকে ঝরে পড়ছেন
- ব্যবসা-বাণিজ্য ফের সঙ্কুচিত হচ্ছে
- ঘরে ঘরে মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম
সোহরাব হোসেন! কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। করোনার প্রকোপে কঠোর লকডাউনে ফের হোম অফিস! ঠিকভাবে বেতন হলেও বোনাস নিয়ে মহাচিন্তায় রয়েছেন তিনি। সামনে রয়েছে পবিত্র কোরবানি। পূর্ণ বোনাস না হলে কোরবানি দেয়াটা কষ্ট হয়ে যাবে। এদিকে পুরো দেশ যেনো এখন নিষিদ্ধ নগরী। সড়কে মানুষ নেই। বাজারে ভিড় নেই। অলিগলির দোকানও বন্ধ। ঘুরছে না গাড়ির চাকা। পরিবারে চাহিদা পূরণে ঘরে ঘরে দুশ্চিন্তা নেমে এসেছে। কঠোরতার যে চিত্র চলছে এটি যদি দীর্ঘ হয় তাহলে অনেক মানুষকে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ফের সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। চাকরি হারানোর ভয় সৃষ্টি হচ্ছে বড় একটি অংশে। অস্বাভাবিক জীবনের উঁকিও দিচ্ছে। মৌলিক চাহিদা পূরণও কষ্ট হয়ে যাবে।
চাকরিপ্রত্যাশীদের অনেকে ঝরে পড়বে এই কঠোরতায়। গতকাল শুক্রবার সকালে কথা হয় হানিফ পরিবহনের চালক আশরাফুল হকের সঙ্গে। তিনি ফেসবুকে তার হতাশা ও কষ্টের কথা লিখেন। আশরাফুল আলম বলেন, ‘গত তিনটি ঈদ পরিবার ও সন্তানদের মুখে হাসি ফুটাতে পারিনি। ঈদ এলেই গাড়ির চাকা বন্ধ হয়ে যায়। গাড়ির মালিকরাও আমাদের দিকে তাকান না। গাড়ি চালালে প্রতিদিন হাজার ১২শ টাকা ইনকাম হয়। আর ঈদ এলে তা দ্বিগুণ পরিমাণে পাই। কিন্তু গত তিনটি ঈদ এই সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত। ঋণ করে সংসার চালাতে হচ্ছে।’
গতকাল শুক্রবার কঠোর লকডাউনে রাস্তায় যাত্রী না থাকলেও রিকশা নিয়ে বেরিয়েছিলেন আহমদ উল্লাহ। শরীর তার বৃষ্টিতে ভেজা। বললেন, ‘বৃষ্টি-বাদল কথা না, রিকশা না চালাইলে খামু কী? বউ বাচ্চাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। ইচ্ছে ছিলো আমিও চলে যাবো। কিন্তু আমি রাজধানীর বসিলায় থাকি। দুই রুমের ভাড়া বাসায়। মাস শেষ হলে আমাকে ৯ হাজার টাকা শুধু বাসা ভাড়াই দিতে হয়। ফ্যামিলির পেছনে খরচ আছে কমপক্ষে ৭-৯ হাজার টাকা। বৃষ্টি হলেও কি করবো বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে। বাসা ভাড়াতো আর মাপ হবে না।’ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার থেকে সারা দেশে লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছে সরকার। অফিস-আদালত, গণপরিবহন, শপিংমলসহ সবকিছুই বন্ধ। তবে রিকশা চলার অনুমতি আছে। লকডাউনে এমনিতেই রাস্তা-ঘাট ফাঁকা। তার ওপর শুক্রবার ছুটির দিন, বৃষ্টিতে লোকজন ঘর থেকে বের হয়নি। ফুটপাথে মানুষের চলাচল নেই।
গতকাল লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে পল্টন, কাকরাইল, শাহবাগ, সাইন্সল্যাব, মালিবাগ, ফকিরাপুল, বিজয়নগর ঘুরে দেখা গেছে, পুলিশের চেকপোস্ট আছে, ব্যারিকেড আছে, তবে যানবাহনে তল্লাশি হচ্ছে আগের দিনের তুলনায় কম। সারা দিন বৃষ্টি হওয়ায় মানুষজনও তেমন রাস্তায় নামেনি। রাজধানীর শাহবাগে কথা হয় ট্রাফিক পুলিশ সাত্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, গত দুদিন কোনো চাপ নেই। রাস্তা প্রায় পুরোটাই ফাঁকা। কোনো যানজটও নেই। আগের লকডাউনে মানুষ যেমন ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হতে দেখা গেছে এবার সেটিও নেই। প্রশাসনের কঠোরতা রয়েছে মজবুতভাবে। গণমাধ্যমে বিষয়গুলো প্রচার হওয়ায় মানুষও বেশ সচেতন। খুব বেশি দরকার না হলে কেউ বের হচ্ছে না। আর যারা শখ করে বের হচ্ছে এমন অনেককেই জরিমানা গুনতে হয়েছে।
আসমাউল হাসান বলেন, ‘সন্তানের কান্না মা-বাবা সহ্য করতে পারে না, যতোই বাহিনী থাকুক, পেটে ক্ষুধা মুখে লাজ এই বাণী গরিব মানুষের মুখে নেই। সন্তানদের জন্য, বাবা-মায়ের জন্য আমাদের হতেই হবে। আমরা না পারছি মানুষের কাছে সম্মানের ভয়ে চাইতেও।’ আরিফ আজম বলেন, যতোই থাকুক যতো বাহিনী; পেটের ক্ষুধা মানবে না কোনো কাহিনী। পেটের চাহিদা পূরণ না হলে আমাকে বের হতেই হবে। এর মধ্যে সামনে ঈদ। রয়েছে অনেক খরচ। আমি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে রাকিব হাসান বলেন, ‘এই পৃথিবীটা শুধুই ওদের জন্য, যাদের টাকা কিংবা ক্ষমতা অথবা দুটিই আছে। আর আমরা যারা মধ্যবিত্ত, আমাদের কেউ নেই।’ কামরুন নাহার নামের একজন ফেসবুকে লিখেন। আজ আমার একজন পরিচিত ভাইয়া সেচ্ছাসেবী রক্ত দিতে গেছেন মিরপুরে। পথে পুলিশ তাকে ধরে ৫০০ টাকা জরিমানা করলো, এই হলো আমাদের দেশের পুলিশের অবস্থা। এটা খুবই অমানবিক। যেখানে এই পরিস্থিতিতে কাউকে রক্তের জন্য খুঁজে পাওয়া কষ্ট সেখানে আবার নাজেহাল করাটা একেবারেই দৃষ্টিকটু।’ আব্দুস সালাম ফরায়েজী বলেন, ‘গার্মেন্টস খোলা রেখে লকডাউন তামাশায় পরিণত হচ্ছে বলে জনগণ মনে করে। অধিকাংশ কর্মীর জন্য নিজস্ব গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়নি। এটা এক ধরনের প্রহসন।’ অথিন আলী বলেন, ‘লকডাউন মানেই যে গরিবের পেটে লাথি শুধু তা না, মধ্যবিত্তের হাহাকারও বটে। তারা লজ্জায় কারো কাছে চাইতে পারে না, বলতে পারে না। নীরবতার এক মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে।’