সারা বিশ্বের একটি নির্দিষ্ট বয়সের তরুণ-তরুণীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ফেসবুক মালিকানাধীন ইন্সটাগ্রাম অ্যাপটি। তবে এবার সেই অ্যাপেরই আভ্যন্তরীণ গবেষকরা প্রকাশ করলেন এক অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানালেন, কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এই অ্যাপ। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে গোপনীয় এই তথ্য। যদিও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে এখনও মুখ খোলেনি। তবে ইন্সটাগ্রামের সাফাই, বিরূপ নয়, মানুষের জীবনে ‘মিশ্র’ প্রভাব ফেলে এই অ্যাপ। রিপোর্টে দেখা গেছে, অ্যাপটি ব্যাবহারকারী নারীদের প্রতি তিনজনের একজন শারীরিক গঠন সংক্রান্ত মানসিক অবসাদের শিকার। শুধু তাই নয়, খোদ কিশোর-কিশোরীদেরই একাংশ দাবি করেছে, ইন্সটাগ্রাম তাঁদের উদ্বেগ এবং মানসিক অবসাদ বাড়ানোর জন্য অনেকাংশে দায়ী। অ্যাপটিতে মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাপন দেখে নিজেদের তুচ্ছ মনে করেন অনেকেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করার উৎসাহ এবং উদ্দীপনা হারান বড় সংখ্যক অ্যাপ ব্যবহারকারী।
ইন্সটাগ্রাম দাবি করেছে, এমন অনেক ব্যবহারকারী আছেন যাঁরা বলেন, এই অ্যাপ তাঁদের জীবনে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অনেকে বলেন, তাঁদের জীবনে কোনও প্রভাবই ফেলে না ইন্সটাগ্রাম। তবে যারা ইতিমধ্যেই মানসিক অবসাদে জর্জরিত, তাঁদের জন্য কখনো কখনো কুফলদায়ক হয় এই অ্যাপটি। ইন্সটাগ্রামের ঋণাত্মক প্রভাব সম্বন্ধে অ্যাপ কর্তৃপক্ষের মত, সমগ্র বিশ্ব জুড়েই সামাজিক তুলনা এবং তাকে কেন্দ্র করে অবসাদ আছে। সোশ্যাল মিডিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়।
তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও বিতর্কে জড়িয়েছে এই অ্যাপ। এর আগে শিশুদের জন্য আলাদা করে একটি ইন্সটাগ্রাম অ্যাপ বানানোর পক্ষে সওয়াল করেছিলেন অ্যাপ নির্মাতারা। সে সময়ে নতুন অ্যাপের বিরোধিতা করেন একাধিক আমেরিকান এটর্নি এবং উকিল। তাঁদের দাবি ছিল, এতো কম বয়সীদের জন্য এমন একটি অ্যাপ হওয়া কখনই যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে শিশুদের শারীরিক, মানসিক সর্বোপরি আবেগের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।
সম্প্রতি ইমেজ শেয়ারিং সাইটটি টিনএজার ব্যবহারকারীদের ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব নিয়ে এক অভ্যন্তরীণ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে বলে জানা যায়। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ওই গবেষণায় হতাশা ও উদ্বেগজনক অবস্থা তৈরির জন্য টিনএজাররা ইনস্টাগ্রামকে দোষারোপ করেছে বলে জানা গেছে।
ক্যাম্পেইন গ্রুপ ও এমপিরা মত প্রকাশ করেছেন, এটা স্পষ্ট কোম্পানি কেবল মুনাফাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। ইনস্টাগ্রাম জানিয়েছে, তাদের এ গবেষণা পরিচালনার উদ্দেশ্য হলো প্লাটফর্মটিতে জটিল ও কঠিন সমস্যাগুলো বোঝা ও সমাধানের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে তা উদ্ঘাটন করা।
ওয়াল স্ট্রিটের প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালের এক চিত্রে দেখা যায়, টিনএজাররা তাদের উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ানোর জন্য ইনস্টাগ্রামকে দায়ী করে। ২০২০ সালের আর এক গবেষণায় দেখা যায়, জরিপে অংশ নেয়া ৩২ শতাংশ তরুণী জানায়, তারা যখন নিজেদের নিয়ে হতাশায় ভোগেন, ইনস্টাগ্রাম সেই হতাশাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। যুক্তরাজ্য থেকে অংশ নেয়া ১৩ শতাংশ তরুণী এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে অংশ নেয়া ৬ শতাংশ তরুণী জানায়, তারা ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ফোকাস গ্রুপ, অনলাইন সার্ভে এবং ডায়েরি স্টাডিজের মাধ্যমে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
২০২১ সালে ইনস্টাগ্রাম কয়েক হাজার ব্যবহারকারীর ওপর বৃহৎ গবেষণা পরিচালনা করে, যাতে নিজস্ব তথ্যের সঙ্গে ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়া সংযুক্ত করা হয়। ব্যবহারকারীরা দিনের কতটা সময় ইনস্টাগ্রামে ব্যয় করেন এবং তারা প্লাটফর্মটিতে ঠিক কী কী জিনিস দেখে থাকেন তা বিশ্লেষণ করে তথ্য সংগ্রহ করেছে সাইটটি।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এ প্রতিবেদনের উত্তরে একটি ব্লগ পোস্টে গবেষণা কার্যক্রমের যৌক্তিকতা নিয়ে মত প্রকাশ করে ইনস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষ। সেখানে তারা উল্লেখ করেন, প্লাটফর্মটিকে সবার জন্য উপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে এ গবেষণা করা হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ ব্যবহারকারীর ওপর নির্ভর করে যে তিনি ঠিক কী খুঁজে পেতে চান। কেউ একজন প্রথমে প্লাটফর্মটির মাধ্যমে সাহায্য পেয়ে থাকলেও পরবর্তী সময়ে তিনি সেখান থেকে ক্ষতিকর কিছুর সম্মুখীন হতে পারেন। আমরা গবেষণার আলোকে যেকোনো ধরনের সাইবার বুলিং, আত্মহত্যা ও আত্মঘাতী পরিকল্পনা এবং খাদ্যজনিত হতাশাকে প্রতিরোধ করার ফিচার সংযুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি।
ইনস্টাগ্রাম জানায়, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল শুধু নেতিবাচক দিকগুলোর প্রতি নিজেদের নিবদ্ধ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা আরো জটিল। আমরা গবেষণার আলোকে বিশেষজ্ঞদের সাহায্য গ্রহণ করব। যাতে লোকজন নিজেদের যেকোনো ধরনের বুলিং থেকে রক্ষা করতে পারে। আমরা ব্যবহারকারীদের জন্য লাইক গণনা করার অপশন গোপন করার ফিচার সংযুক্ত করতে যাচ্ছি, একই সঙ্গে যেসব ব্যবহারকারী হতাশায় ভুগছেন তাদের স্থানীয় সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখব। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের গবেষণার ক্ষেত্রে আরো স্বচ্ছতা অবলম্বন করার প্রতিশ্রুতি দেয় ইনস্টাগ্রাম।
[তথ্যসূত্র : সিএনএন, বিবিসি]